Managing Director & CEO, ACI Motors Limited, ACI Agrolink Limited, Premiaflex Plastics Limited, ACI Agribusinesses
গরু থেকে কিন্ত অনেক ধরনের উপাদান পাওয়া সম্ভব। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিকে তাকালে বলতে পারি যে, তারা গোবরকে সার হিসেবে জমিতে দিয়ে ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারছে। গরুর দুধ ও মাংস বিক্রি করে সে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে; অন্যরা দুধ ও মাংস খেয়ে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছে। গরুর চামড়া অন্যতম অর্থকরী পণ্যের সংস্থান দিচ্ছে। তার মানে, আপনি যদি সঠিকভাবে গরু পালন করতে পারেন; তাহলে এটি অমিত সম্ভাবনাময় একটি খাত হবে। গো সম্পদকে কেন্দ্র করে সরকার আরো ভাবতে পারে। আরো বেশি উৎপাদন অর্থাৎ বৃহৎ শিল্প খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপি আরো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে – আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবিটিভির কাছে বাংলাদেশে গরু পালনের অর্থনীতির বিশদ সম্ভাবনার কথা বলেছেন এসিআই এগ্রিবিজনেসের এমডি, ড.এফ এইচ আনসারী। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।
দেশের অর্থনীতিতে গরু পালনের ভূমিকা ব্যাপক
আসলে ৫০ থেকে ১০০ বা ২০০ গরু নিয়ে আপনি আধুনিকভাবে একটা খামার স্থাপন করতে পারেন। এতে করে সারা দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। ফলে তারা দুধ পাবে, মাংস পাবে, সার পাবে। এই মডেলটি কিন্ত তখন ভালো একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারবে।
আমাদের দেশের জন্য ডেইরি ও ক্যাটল ফার্ম, অত্যন্ত সুইটেবল ও এপ্রোপ্রিয়েট একটি বিষয়। কারণ আমাদের দেশে প্রচুর মানুষ বাস করে। তাদের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার, যেমন, মাংসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় এক কোটির মতো। তারা গরুর মাংস ও দুধ কিনে খেতে পারে। এ দেশের মানুষ প্রায় চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার সফট ড্রিংকস ও তরল পানি কিনে খাচ্ছে। এ বিষয়টিও কিন্ত দুধের একটা বড় বাজার হতে পারে। তাছাড়া আমরা চামড়া প্রসেস করে আন্তর্জাতিক বাজারে অবদান রাখছি। এ শিল্পটা আমাদের অনেক পুরোনো ব্যবসা। আমরা জানি, এ ব্যবসা কী করে করতে হয়। আবার এদেশে অর্গানিক সারের খুব অভাব। গরুর গোবরকে কাজে লাগিয়ে এই সারের অভাবও পূরণ করা যায়। তাছাড়া অনেক রিমোট এলাকায় এখনও গ্যাসের সরবরাহ নেই। সেখানে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করে আমরা গ্যাসের অভাব পূরণ করতে পারি।
যারা গরু লালন পালন করবে তারা কিভাবে এ প্রক্রিয়ায় উন্নতি করবে এটা জানা জরুরি। আসলে দেশের প্রান্তিক মানুষ যারা গরু পালনে আগ্রহী; তারা বেশিরভাগ সময়ই সঠিক তথ্য জানতে পারেন না। তারা জানেন না, উন্নত সিমেন কোথায় পাওয়া যায় কিংবা যারা এ ধরনের সীমেন সরবরাহ করে তাদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে, প্রাইভেট কোম্পানিগুলো ঠিক কেমন করে কাজ করবে, তারা কিভাবে সবার সঙ্গে সাচ্ছ্যন্দে কাজ করতে পারবে। এই ব্যবসায় সরকার কী পলিসি তাদের সঙ্গে প্রয়োগ করবে । আমার ধারণা, বিদেশি কোম্পানিগুলো এই ব্যবসায় তাদের টাকা লগ্নি করবে। কারণ তারা জানে এদেশের বাজার অনেক বড়। এমন হলে সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। দরকার ভালো পলিসি
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, প্রান্তিক সাধারণ মানুষ যারা দুধ উদপাদন করেন, যারা স্বল্প সংখ্যক গরু মোটাতাজা করেন, বিদেশিরা এলে তাদের অবস্থা কী হবে?
সাধারণত দেখা যায়, সারা বিশ্বেই কিন্ত ছোট ছোট আকারে বিভিন্ন ধরনের গরুর খামার রয়েছে। তারা কেমন করে চলে? তাদের ওই সব কোম্পানি প্রয়োজনীয় সিমেন দেয়, খাবার দেয়, গরুর স্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী সাপ্লাই দেয়, অর্থাৎ সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। এর পর তারা ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ করে। এর মাধ্যমে তারা খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে। যারা দুধ প্রসেস্ করে তারা প্রসেসিংয়ে যায় । যারা মাংস সংগ্রহ করে তারা মাংস প্রসেস করে বাজারে সাপ্লাই দেয় আবার বিদেশে রপ্তানি করে। এ থেকে আসলে কী বোঝা যায়? বোঝা যাচ্ছে, আমাদের লাগবে ভালো পলিসি।
পলিসির ব্যাপারে যা বলতে চাই : সব কিছুই সঠিকভাবে সম্ভব হবে যদি আমাদের পলিসিগুলো স্বচ্ছ এবং তার ধারাবহিকতা থাকে। পলিসিতে যা লিখা থাকবে সেভাবেই তা অনুসরণ করা হবে; এর পরিবর্তন হবে না। এবং একটা শক্ত সক্ষম বোর্ডের মাধ্যমে তা পরিচালিত হবে। তাহলেই দেখা যাবে, এখানে বিনিয়োগের জন্য দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে। ফলে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এককভাবে গরু পালনকারী, সবাই সমানভাবে উপকৃত হবে। ধনী গরীবের ফারাক থাকবে না।
আমাদের দরকার ডেইরি বোর্ড : পলিসি সাপোর্ট করার জন্য প্রয়োজন হবে ডেইরি বোর্ড। স্বতন্ত্র এই বোর্ড থাকবে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বোর্ড সব সময় তাদের সার্বিক কার্যক্রমের রিপোর্ট করবে মন্ত্রণালয়ে। তখন সাধারণ মানুষ আর প্রাইভেট প্রতিনিধি হবেন সমান। বোর্ড সিদ্ধান্ত নিবে যে, তারা কিভাবে দেশের গো সম্পদ সুরক্ষা করবে, কিভাবে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করবে, ছোট বড় খামারকে সহযোগিতা করবে। এই সমস্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নির্ধারণ করবে যে তারা কিভাবে এগোবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ডেইরি বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। কিন্ত ভয় লাগে যে এই বোর্ডের রেপুটেশন কেমন থাকবে; বোর্ডের সদস্য যারা থাকবেন তারা কেমন হবেন এসব নিয়ে। দেখা গেল, বোর্ডের মেম্বার দু'একজন থাকলেন রেপুটেড আর বাকি সব সরকারি কর্মচারি তা হলে ঘুরে ফিরে সেই ডিএলএস এর মতো একটি সংগঠন না তৈরি হয় আবার। সেখানে তাহলে স্বাধিনভাবে কোন কিছু করার থাকবে না। আমি চাই এমন একটা বোর্ড গঠন করা হবে যেখানে প্রাইভেট সদস্যরা থাকবেন অর্ধেক আর পাবলিক সদস্য থাকবেন অর্ধেক। সেখানে যারা গরু পালন করেন তারা থাকবেন, ফীড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি থাকবে,যারা ডেইরি চেইন করেছেন তাদের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। নীট চেইন যারা করেছেন তারাও থাকবেন। সব মিলিয়ে একটা ভালো ও শক্ত বোর্ড হবে। আর পলিসি থাকবে ধারাবাহিকভাবে ৫০ বছরের জন্য। তখন প্রাউভেট কোম্পানি, বিদেশি কোম্পানি সবই আসতে পারবে। আর এমন স্থায়ী ও ধারাবাহিক পলিসির কারণে বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে
বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ : আসলে দেখতে হবে যে, মার্কেট সাইজ কত বড়। অভ্যন্তরীণ মার্কেট কত বড় এবং পজিশনিং মার্কেট কত বড় আছে সেটা জানা খুবই গুরুত্তপূর্ণ। আমরা সবাই ভালো করে জানি যে আমাদের অভ্যন্তরীণ মার্কেট অনেক বড়। এবং আমাদের মধ্যবিত্ত জনসংখ্যাও কম নয়। আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী তরল দুধের বাজারও অনেক বড়। আমাদের অনেক পরিসংখ্যান রয়েছে যেগুলোকে বিশ^াস করার প্রয়োজন নেই। সে তুলনায় আমাদের দুধ উৎপাদনের হার অনেক কম। কিন্ত এর সম্ভাবনা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এ দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসেন কিন্ত যখন দেখে যে, আমাদের পলিসিগুলো ট্রান্সপারেন্ট না, ধারাবাহিক না, তখন তাদের আগ্রহ কমে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের পলিসি হতে হবে স্বচ্ছ ও ধারাবাহিক। যা পড়ে যে কেউ সঠিক ধারণা নিয়ে এগোতে পারে। আর তখনই তারা আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসবে বিনিয়োগে। আমি মনে করি আমাদের দেশে প্রতিদিন দুধ উৎপাদনের জন্য অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আসছে। এসে এদিক সেদিক দেখে, চারপাশের অবস্থা বিবেচনা করে তারা ভাবছে আসলে তারা কি করবে। আসলে একটা পলিসি কতটা স্বচ্ছ, কেন বারবার পরিবর্তন হচ্ছে, আগের পলিসি কী ছিল এখন কেমন, সরকার কতটা সহযোগিতা করছে, বর্তমান বিনিয়োগকারীরা কেমন করছে এসব ব্যাপারে আসলে দ্বিধা কাজ করে। আজ পোলট্রি সেক্টরের দিকে দেখেন, যেখানে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। সিপি করেছে, নিউ হোপ করেছে। একইভাবে কিন্ত দুধ উৎপাদন বা গরু পালনেও সেই বিনিয়োগ হতে পারে।
বিদেশিরা কিভাবে তাদের বিনিয়োগ করবে : আসলে দেখা যায়, চাইলেই তো আর তারা এখানে চলে আসতে পারে না। তাদের যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। এবং সেটাই হয়। কারণ ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন পরিবেশ। আর জনশক্তিও এখানে আলাদা। এজন্য অভ্যন্তরীণ সব কিছু বিবেচনা করে তাদের অ
বশ্যই যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে হয়। আর যারা আসছে বা আসার চিন্তা করছে তারা কিন্ত লোকাল পার্টনার নিয়েই ব্যবসা শুরু করবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিনিয়োগকারীও তো বেশি নেই। এর কারণ আমাদের স্বচ্ছ নীতিমালার অভাব,
সরকারের সহযোগিতার অভাব। ভালো ব্রিড উৎপাদন ছাড়া আমাদের ক্যাটেল ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এজন্য উন্নতমানের বিনিয়োগের প্রয়োজন। তার জন্য দরকার স্বচ্ছ ও ধারাবাহিক নীতিমালার।
সরকারি উদ্যোগের কী অবস্থা : আমরা দেখেছি, সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা তাদের পলিসি অনুযায়ী কাজ করছে। সেক্ষেত্রে আমরা কৃষক বা স্থানীয়দের সাথে আলোচনা করে বুঝেছি যে, তারা অনেক ভালো করছে এবং তারা অনেক আত্মবিশ্ববাসী। তাদের অনেকের গরুর ওজন আড়াই বছরে প্রায় ৬০০ কেজি হয়েছে । আসছে বছরে এর ওজন হবে এক টন । এর জন্য বাড়তি কোনও কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। স্বাভাবিকভাবে গেরস্তরা যেভাবে গরু পালে তারা সেভাবেই লালন পালন করছে, খাবারেও তাই। শুধু বাড়তি একটু যত্ন নিয়েছে তারা। বেলজিয়াম ব্লু নামে গরুর একটি ব্রীড আছে । এই জাতের গরু আড়াই থেকে তিন বছরে প্রায় দুই টন ওজনের হয়ে যায়। এটা আরো প্রো-এক্টিভ। এ ব্যাপারে অনেক পশু বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বললে তারা হাসাহাসি করেন। তারা মনে করেন, এতো হাই টেম্পারেচারে এরকম গরু পালন সম্ভব হবে কি না। আমার মনে হয় দেশে সবকিছুই তো অভ্যস্ত হয়েছে। ফার্মের সাদা ব্রয়লার মানিয়ে নিতে তো অনেক বছর সময় নিয়েছে। তাতে কি এখন কি সেটা উৎপাদন হচ্ছে না? হচ্ছে তো। এখন আমাদের দেশের মানুষ পোল্ট্রি উৎপাদন করতে সক্ষম, তারা জানে কিভাবে খাবার দিতে হয়, কিভাবে ঔষধ দিতে হয়, কিভাবে পরিচর্যা করতে হয়। আসলে এটা একটা চর্চার ব্যাপার। সঠিক নিয়মে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে বেলজিয়ান ব্লু কেন সম্ভব নয়?
এসিআই এজন্য কী করছে : আমরা সিমেন উৎপাদন করছি,উন্নতমানের মাংসের জন্য ষাড়ের স্টেশন করছি। দুধ উৎপাদনের জন্য আমরা খুব শিগগিরই কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা ক্যাটেল মেডিসিনেও বেশ ভালো করছি। ক্যাটেল হাইজেনিক সেন্টার করেছি, ক্যাটেল ডায়াগনস্টিক সেন্টার করেছি। সেখান থেকে আমরা সব রকমের সেবা দিচ্ছি।
আমাদের দেশে কী পরিমাণ গরুর চাহিদা রয়েছে : আসলে সারা দেশের চাহিদা অনুসারে দেশে ২ কোটি বা সোয়া দুই কোটি গরুর চাহিদা কোনো না কোনোভাবে থাকেই। তার মানে, রোলিং আকারে সেটি তো চলছেই । ঈদের সময় ৫০ বা ২৫ বা ৩০ ভাগ নেমে গেলেও সেটা তো আবার সারা বছর পর্যায়ক্রমে উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে ডেইরির কথা বললে, বলতে হবে যে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম দুধ উৎপাদন হচ্ছে আমাদের। তার জন্য বাইরে থেকে আমাদের দুই হাজার কোটি টাকার গুড়ো দুধ আমদানি করতে হচ্ছে। এমনকি সরাসরি গরুও আমদানি হচ্ছে দেশে। যা চাহিদার তুলনায় আরও বাড়তে পারে। আসলে সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে দুধের চাহিদার অনুপাতে অর্ধেক উৎপাদন করা যাবে। কিন্ত আমরা প্রডাক্ট দুধ বাদেও উৎপাদন ১০ গুণ বাড়াতে পারি। যার চাহিদা দিনদিন বাড়তেই থাকবে।
আর মাংসের কথা যদি বলি, চাইলে আমরা উৎকৃষ্টমানের মাংসের উৎপাদন করতে পারি। তাতে করে মাংসের দামও অনেক কমিয়ে আনা যাবে। আমার মতে, ৩০০ টাকা কেজিতে তা বিক্রি করা সম্ভব। আর তা যদি করা সম্ভব হয় তবে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনও অনেক বেড়ে যাবে। ফলে সবাই গরুর মাংস খেতে পারবে। এই গরুর মাংস কিন্ত ছোট বাচ্চাদের জন্য বা বাড়ন্ত শিশুদের জন্য অনেক পুষ্টি সম্পন্ন। এটা ব্রেনের সঠিক গঠনের জন্যও কাজ করবে। এজন্য আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের উন্নতির জন্য তাদের গরুর মাংস খাওয়াতে হবে।
দুধ ও মাংসের বাইরে গরুর চামড়ার সম্ভাবনা কোথায় : আসলে গরুর চামড়া অনেক মূল্যবান একটি উপাদান। যদি আমাদের দেশে গরুর উৎপাদন বাড়ে, মাংসের চাহিদা বাড়ে বা মাংস রপ্তানি হয় তাহলে তো চামড়ার কথা আসবেই। আর এর জন্য চাহিদার তুলনায় বেশি চামড়া উৎপাদন করা গেলে আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্য পাওয়া যাবে। কারণ গ্লোবাল মার্কেটে এই চামড়ারর ভালো চাহিদা রয়েছে। তাহলে সে মার্কেটও আমরা ধরতে পারব।
মাংস রপ্তানি করা সম্ভব : ক্যাটেল মিটের চাহিদা বিশ^জুড়ে। সে অনুযায়ী ইতিমধ্যে দেশের দু'একটা প্রতিষ্ঠান ক্যাটেল মিট রপ্তানি করছে। সে অনুপাতে যদি সঠিকভাবে উৎপাদন করতে পারি তা হলে বিশ^বাজারে আমরা মাংস ব্যাপক হারে রপ্তানি করতে পারব। তাছাড়া আমরা যেহেতু মুসলিম কান্ট্রি সে হিসেবে আমাদের মিটের চাহিদা থাকবে। কারণ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে হালাল মিটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মিডলইস্ট ছাড়া ইন্দেনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে আমরা এই মাংসের যোগান দিতে পারি।
জৈব সার হিসেবে গোবরের চাহিদা :প্রটেনশিয়াল মার্কেট হিসেবে অর্গানিক বা জৈব সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে আমাদের। আর এর অন্যতম উপাদান হলো প্রাকৃতিক গোবর সার। আমাদের দেশে একই জমিতে দুই থেকে তিনটা ফসল হয়। আর বার বার উৎপাদন হবার কারণে মাটি কিন্ত তার উৎপাদন ক্ষমতা হারায়। অনেক সময় মাটি শক্ত হয়ে ভেতরে বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। তখন মাটিকে ফাঁপা রাখার জন্য বাড়তি জৈব উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। আর তখনই গোবরকে অর্গানিক সার হিসেবে ব্যাবহার করলে মাটির উর্বরতা বাড়বে। তখন সেখানে কিন্ত ফসল ভালো হতে বাধ্য। আমরা দেশে সবচেয়ে বড় অর্গানিক সার উৎপাদকারী একমাত্র কোম্পানি। টোটাল চাহিদার ৬০ ভাগ আমরা সাপ্লাই দিতে পারি। কিন্তু তা পারছিনা; কারণ এর কাঁচামাল হিসেবে গোবরসহ অন্যান্য কিছু আমরা পাই না। এক লক্ষ বিশ হাজার মেট্রিকটন চাহিদা রয়েছে মার্কেটে। যেখানে আমরা ১০-১২ হাজার মে: টন উৎপাদন করতে পারছি। এতো বড় একটা মার্কেট যেখানে ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য এমন অর্গানিক সারের উৎপাদন করা অবশ্যই প্রয়োজন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গরু থেকে কিন্ত অনেক ধরনের উপাদান আপনি পাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিকে তাকালে বলতে পারি যে, তারা গোবরকে সার হিসেবে জমিতে দিয়ে ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারছে। গরুর দুধ ও মাংস বিক্রি করে সে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে, অন্যরা দুধ ও মাংস খেয়ে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছে। গরুর চামড়া অন্যতম অর্থকরী পণ্যের সংস্থান দিচ্ছে। তার মানে, আপনি যদি সঠিকভাবে গরু পালন করতে পারেন; তাহলে এটি একটি অমিত সম্ভাবনাময় একটি খাত হবে। তাই বলছি গো সম্পদকে কেন্দ্র করে সরকার আরো ভাবতে পারে। আরো বেশি উৎপাদন অর্থাৎ বৃহৎ শিল্প খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপি আরো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
কর্মসংস্থান ও গরুর খামার: একটি ছোট কিংবা মাঝারি ধরনের উন্নত জাতের গরু সমৃদ্ধ খামার, একজন যুবকের কর্মসংস্থানের ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে এজন্য খামার ব্যাবস্থাপনা ভালো হতে হবে। সাধারণত একটা লাভজনক স্থায়ী খামার করতে হলে ১০০ থেকে ২০০ গরু নিয়ে শুরু করাই ভালো। কারণ তখন আধুনিক সব টেকনোলজির ব্যবহার করতে পারবেন।
আসলে সেরকম একটা খামারে সনাতন পদ্ধতি খুব একটা কাজে দেবে না। মেকানিক্যাল ইন্টারভেনশন ছাড়া গরু পালন রিস্কি। আপনাকে আধুনিক বিশে^র সঙ্গে তাল দিয়ে চলতে হবে। আর তখনই আপনার খামার সাস্টেইনেবল হবে। যেমন,আপনি যখন সনাতন পদ্ধতিতে দুধ দোয়াতে যাবেন তখন একটার পর একটা গরু দোয়ানোর সময়, গরুর ওলানে ইনজুরি হবার সম্ভাবনা থাকে। আর তখন দুধ উৎপাদন অর্ধেক কমে যাবে। এ জন্য রোবোটিক সিস্টেমে দুধ দোয়ানোর ব্যবস্থা থাকলে আপনি পরিপূর্ণভাবে দুধ পাবেন, শ্রমিকের পরিমাণ কমে আসবে, নিরাপদ ও জীবানুমূক্ত দুধ পাবেন। তাছাড়া গরুকে আপনি সহজেই সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারবেন। খামারে যত মানুষের সংখ্যা কম হবে তত জীবানু সংক্রমণের সংখ্যাও কমে আসবে। এতে করে আপনার খামার থাকবে জীবানু ও রোগমুক্ত। আসলে ৫০ থেকে ১০০ বা ২০০ গরু নিয়ে আপনি আধুনিকভাবে একটা খামার স্থাপন করতে পারেন। এতে করে সারা দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। ফলে মানুষ দুধ পাবে, মাংস পাবে, সার পাবে। এই মডেলটি কিন্ত তখন ভালো একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারবে।
গরুর খামার করতে কেমন বিনিয়োগ প্রয়োজন : ৫০ থেকে ২০০ গরু নিয়ে একটা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে না। লাখ দশেক টাকা হলেই যে কেউ এমন ফার্ম স্টার্ট করতে পারবে। আমরা যে কাজটা করি সেটা হলো ,গরুর ঘর বানাতেই ২০ লাখ টাকা খরচ করে ফেলি। পিছন ফিরে তাকালে কি দেখবেন একসময় প্রাণীরা থাকত জঙ্গলে। এখন বাসাবাড়িতে রাখা হয়। তাও আবার দালানকোঠায়। এটা ঠিক না। যখন আপনি পশুকে ঘরের মধ্যে রাখবেন, তখন তো সেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস আসবে না। তাহলে কী করা ? সে জন্য শুধু উপরে একটা কিছু দিয়ে কভার।
করলেই হবে। যাতে রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডা এসে সরাসরি গরুর উপর না পরে; এটুকুই যথেষ্ঠ। তাহলে চারপাশে বাতাস আসবে, বৃষ্টিতে গরু ভিজলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না। তাহলে কী হবে, তাদের শরীর পরিষ্কার থাকবে, বাতাস পরিষ্কার থাকবে এবং গরুর বৃদ্ধি দ্রুত হবে। শুধু মশার একটা সমস্যা আছে, তবে তার সমাধানও আছে। আজকাল বাজারে নেট পাওয়া যায়, ঘরের চারপাশে নেট লাগিয়ে দিলে মশা আর লাগবে না, মারা যাবে। তাহলে সহজেই আপনি গরু লালন পালন করতে পারবেন। একজন শক্ত সমর্থ যুবক মাত্র ১০ লাখ টাকা খরচ করলেই এরকম একটা খামার স্থাপন করতে পারে। তাহলে তার ব্যবসাটাও ভালো হবে। যেখান থেকে প্রায় ৩০ ভাগ মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
অন্যরকমভাবে একটা হিসাব দিই । একজন গরীব মানুষ একটা গরু পালন করলো। সে দুধ পাবে দেড়-দুই লিটার। সে দুই লিটারের দাম পাবে ৪০ থেকে ৬০ টাকা। সে জায়গায় একজন শিক্ষিত যুবক যে কি না সবধরনের আধুনিক জ্ঞানে হাইব্রিডের গরু পালন করেছে। সে দুধ পেল ১৫ থেকে ৩০ লিটার পর্যন্ত। এখানে ১৫ লিটার দুধের মূল্য ৬০০ টাকা, প্রতিদিনের খাবার ও মেইনটেনেন্স বাবদ খরচ ৪৫০ টাকা। তাহলে থাকছে ১৫০ টাকা। তাহলে দাঁড়ালো, একজন টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে আর আরেকজন আয়েস করে ১৫০ টাকা গুনছে প্রতিটা গরু থেকে। এভাবে ৫০টি গরু থেকে আপনি দুধ পাবেন না। কোন গরু দুধ দেবে, কোনটা প্র্যাগনেন্ট হবে। এভাবে সার্বিকভাবে আপনি ৫০ভাগ গরুর কাছ থেকে চক্রাকারে দুধ পাবেন।
এ জন্য আপনার আধা একর জায়গার প্রয়োজন হবে। আপনাকে যে জায়গা কিনতে হবে তা কিন্ত না। চাইলে আপনার পাশের জমিটা দুই-তিন বছরের জন্য ভাড়া হিসেবেও নিতে পারেন। কারণ দেখেন, যেখানে ধান বা ফসল করে হয়তো বছরে আপনি ৮০০০ টাকাও পান না। সেখানে যদি এর বেশি টাকা পাওয়া তাহলে কেন ভাড়া দেবে না? তাছাড়া ভাড়া করা জায়গায় আজকাল অনেকেই অনেক কিছু করছে। সুতরাং এটা করাই যায়। এভাবে সম্ভব। শুধু ভালো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রোগমুক্ত পরিবেশ, আর সুন্দর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কি রকম সহযোগিতা আছে : বাংলাদেশ সরকারের পর একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসিআই-ই সবচেয়ে বড় কোম্পানি, যারা সারা দেশে কৃষি উন্নয়নের জন্য ভেটেরিনারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে অবিরত। প্রায় ৯০ জনের বেশি পশু চিকিৎসক আমাদের এখানে কাজ করেন। তারা প্রতিনিয়ত প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে কাজ করছেন। এটা কিন্ত কম কথা না। আমরা যেকোনো সময়, তাদের কাছাকাছি থেকে পুরোপুরি সুপারভাইজ করে, তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারব। আমরা যদি এভাবে তিন চারটা ফার্মকে সুপারভাইজ করে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে আমাদের কাজটা আরো সহজ হয়ে গেল। এ কারণেই আমরা এটা করি। তাছাড়া আমাদের তো একটা মিশন আছে যে 'ক্রিয়েট ওয়েলফেয়ার অব ফার্মার'। সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। যতটা না মানুষ আশা করছে তার চাইতেও বেশি আমরা করতে চাই।
ঋণের ব্যাপারে আমাদের ভাবনা : আসলে আমরা লোন নিয়ে কাজ করছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের অন্যান্য অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এসব কাজে লোনের ব্যবস্থা করে থাকে। তাছাড়া সারা দেশের সবাই তো আর এ মাধ্যমে আসবে না। গ্রামের মোটামুটি শিক্ষিত মানুষ এগিয়ে আসছে এবং তারা তাদের অর্থের সংস্থান করেই আসছে। আমি মনে করি, কোন গ্রামে যদি কেউ খামার করার জন্য এগিয়ে আসে তাহলে সে তার আশেপাশের সবার কাছ থেকে, বাবা-মায়ের কাছ থেকে, অবশ্যই সাপোর্ট পাবে এবং এভাবেই সবাই আসছে ।