নির্বাহী পরিচালক, এসিআই লিমিটেড
হালাল সাবানের পেছনের গল্পটা কেমন ছিল?
দুই দশক আগে নতুন একটি সাবান চালুর ধারণা দেয়া হয় আমাকে। কিন্তু পণ্যটি কীভাবে বাজারে আনব, তা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। কারণ তখন ইউনিলিভারের লাক্স সাবান মার্কেট লিডার। তাই নতুন চিন্তা ও ব্র্যান্ডিং ধারণা নিয়ে হালাল সাবানের ধারণাটি চালু করি। একটি স্লোগানই যেকোনো পণ্যকে মার্কেট লিডারে পরিণত করতে পারে, তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ হালাল সাবানের ধারণা। প্রায় দুই দশক আগে ‘একশ ভাগ হালাল’ সাবানের স্লোগান এখন কালজয়ী। স্লোগানটির কারণেই সে সময় অ্যারোমেটিক সাবান দ্রুত বাংলাদেশের ১ নং সাবান হিসেবে সমাদৃত হয় এবং বিশ্বের ১ নং সাবান লাক্স বাংলাদেশে বাজার হারায়। সারা বিশ্বের পণ্য বিপণন জগতে হালাল পণ্য তৈরির জন্য আমার পরিচিতি এনে দেয়। আমার এ ধরনের সাফল্যের কারণে মার্কেটিংয়ের গুরু ফিলিপ কটলার তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপলস অব মার্কেটিং’য়ে আমার কার্যক্রম এবং ‘একশ ভাগ হালাল’ স্লোগানটা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পরবর্তীতে দেশের মানুষ আমাকে ‘বাংলাদেশের ফিলিপ কটলার’ নামেই ডাকে। বাংলার মানুষের এ স্বীকৃতিই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি।
এফএমসিজি ও খাদ্যপণ্য বিপণনের জন্য কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
যেকোনো পণ্য বিপণনে অবশ্যই ভোক্তাকে বুঝতে হবে। ভোক্তার চাহিদা ও আর্থিক সক্ষমতা বোঝার মাধ্যমেই পণ্যের বিপণনে সার্থকতা আসতে পারে। তাছাড়া বিপণনের জন্য চাহিদাও সৃষ্টি করতে হবে। যেমন বাংলাদেশে এক সময় কেডস এরপর ্ব পৃষ্ঠা ২ কলাম ৪
জুতার প্রচলন ছিল না। কিন্তু পর্যায়ক্রমে দেশে সেটি চালু হয়। সাধারণ জুতার পরিবর্তে মানুষ এটিকে আরামদায়ক ও স্বস্তিদায়ক পাদুকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভোক্তাকে বোঝা ও চাহিদা সৃষ্টি করার মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা অনুসারে প্রয়োজনীয় ও উত্তম পণ্য দেয়াই হলো মার্কেটিংয়ের মূল মন্ত্র। তাছাড়া মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একটি প্রতিষ্ঠানকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। শুধু মুনাফার আশায় ব্যবসা করলে, তা বেশি দিন টেকসই হতে পারে না। সাময়িকভাবে হয়তো ব্যবসায়িক সফলতা আসতে পারে। এ দায়বদ্ধতা শুধু পণ্যের মান নির্ধারণ নয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বিবেচনায় নিতে হয়।
পেশা হিসেবে মানুষ কেন বিপণনকে বেছে নেবে?
কয়েক দশক ধরে আমি বিপণন পেশায় নিয়োজিত। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ভালো বিপণনকর্মী হতে হলে তিনটি ধাপে শ্রেণীকরণ করতে হবে। এন্ট্রি লেভেল, মিড লেভেল ও পলিসি লেভেল। সব লেভেলেই বিপণনের পূর্বশর্ত মানতে হয়। কিছু পণ্যের চাহিদা নিত্যদিনের। এ ধরনের পণ্য এমনিতেই বাজার প্রবেশ করানো সম্ভব। তবে শুরুতেই ভোক্তাদের কী চাহিদা, সেটি জানাবে বিপণনের শুরুর ধাপের কর্মীরা। ডিমান্ড গ্যাপ কী রয়েছে, সেটি সম্পর্কে ধারণা দেবে। নিয়মিত কাজের বাইরে বাজারের সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে মিড লেভেলে সরবরাহ করবে। মিড লেভেলের বিপণনকর্মীরা সে পণ্যের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সুপারিশ করবেন। মিড লেভেলের কর্মীদেরকেই বেশি ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে হয়। নীতি নির্ধারণ পর্যায় ভোক্তাদের চাহিদামাফিক ও কোম্পানির আর্থিক সঙ্গতি রেখে পণ্য উৎপাদনে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। আর সেই পণ্যকে নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করবে। যেমন আমাদের পণ্য লবণের ক্ষেত্রে নতুন স্লোগান ঠিক করেছি। এসিআই লবণ ‘মেধা বিকাশে সাহায্য করে’। যার মাধ্যমে আমাদের পণ্যের গুণাগুণ ও এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি। মানুষ সেটি সাদরে গ্রহণ করেছে। গুণগত মানের কারণেই এসিআই লবণ পরপর পাঁচবার সেরা ব্র্যান্ড হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে। প্রথমবার সব খাদ্যপণ্য ও পানীয় সামগ্রীর মধ্যে এসিআই লবণ প্রথম পুরস্কার অর্জন করে।
বিপণন পেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। সে সঙ্গে আনন্দদায়কও বটে। যখন নিজের সৃষ্ট কোনো ব্র্যান্ড সফল হবে, দেশের আপামর ভোক্তা যখন আপনার দেয়া সামগ্রী হূষ্টচিত্তে গ্রহণ করবে, সে বিষয়গুলো আপনি যখন উপভোগ করবেন, তখন তার মূল্য অনেক বেশি।
এসিআইয়ের কোন পণ্যগুলো এখন বাজারে ভালো অবস্থানে আছে?
এসিআই কনজিউমার ব্র্যান্ডসকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডে পরিণত করার চেষ্টা করছি। এসিআই দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। আমাদের পরিকল্পনা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা। সে ধারণা থেকেই এসিআই কিছু মূল্যবোধ মেনে চলে। গুণগত মান, ক্রেতামুখিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা, ধারাবাহিক উন্নতি, উদ্ভাবন— এ মূল্যবোধগুলো প্রতিটি কর্মী মেনে চলে। এসিআই পণ্যের গুণগত মান ও মোড়কজাত প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের। আমার পরিবারে যেসব পণ্য ব্যবহার করতে পারব, আমি সে পণ্যই ক্রেতাদের দিয়ে থাকি। পণ্যের মূল্য নির্ধারণেও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়। ক্রেতারা সাধ্যমতো যেন পণ্য কিনতে পারেন, সে দিকটি মাথায় রাখি আমরা। এসিআই অ্যারোসল, মশার কয়েল, স্যাভলন, এসিআই লবণ, পিওর আটা, ময়দা, সুজি, এসিআই পিওর মসলা বাজারে নেতৃস্থানে এগিয়ে রয়েছে। এসিআই অ্যারোসল ৯৫ শতাংশ এবং স্যাভলন ৮০ শতাংশ মার্কেট দখল করে আছে। বাংলাদেশের প্রথম উন্নত ধরনের স্যান্ডাল সাবান বিপণনের মাধ্যমে আমরা এ পণ্যের নেতৃত্ব নিয়েছি। স্যাভলন সাবান এখন অনেক ভালো করছে। সামনের দিনে আরো বেশ কয়েকটি পণ্যে নাম্বার ওয়ান হতে পারবে এসিআই।
ভোগ্যপণ্য বিপণনের পূর্বশর্ত কী?
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ভালো অবকাঠামো। ভালো অবকাঠামো করতে পারলে একটি দেশ এমনিতেই এগিয়ে যায়। তখন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে, যার প্রভাব আমরা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ধীরে হলেও দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। মানুষের যখন আয় বেড়ে যায়, তখন সে নতুন পণ্য কিনতে চায়। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটানোর পরই ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিলাসদ্রব্য কিনতে চায়। তাই ভোক্তা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন ও সে পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। পাশাপাশি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে কার্যকরভাবে। নতুন পণ্য সম্পর্কে ভোক্তাদের ধারণা দিতে হবে। তাহলে নতুন যেকোনো পণ্যই গুণগত মানসম্পন্ন হলে ভোক্তারা সাদরে গ্রহণ করবে।
নতুন পণ্যের বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জনশক্তি দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি মেধাবী। আবার তরুণ জনগোষ্ঠীও বাড়ছে। এসব দিক বিবেচনা করে নতুন নতুন পণ্য আনার চেষ্টা করছে এসিআই। ‘পিওর’ ব্র্যান্ডের পণ্য যেমন এসিআই পিওর লবণ, চাল, গম ও আটা-ময়দা রয়েছে। ‘স্টাইলাস’ ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন ও ‘স্পার্কল’ ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য আনা হয়েছে। এর মাঝেই বিশ্বের নামকরা কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশেও বিশ্বের নামকরা সব ব্র্যান্ড আসতে শুরু করবে। নতুন প্রযুক্তি, নতুন জ্ঞান ও নতুন মেধা আসবে। আমরাও আমাদেরকে প্রস্তুত করছি। ২০২০ সালের মধ্যেই আমরা নতুন পণ্য আনার মাধ্যমে ব্যবসা আরো বেশি সম্প্রসারণ করতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। আমরা আমাদের পণ্য দিয়ে ভোক্তাকে সন্তুষ্ট করব। ভোক্তাকে অনেক খুশি ও সন্তুষ্ট করবে এসিআইয়ের পণ্য। ভোক্তাদের আস্থার কথা মাথায় রেখেই নতুন নতুন পণ্য আনবে এসিআই। এসিআই ভ্যালু ড্রিভেন কোম্পানি। ভালো পণ্য দেবে, পণ্যের গায়ে যা লেখা থাকবে, তা-ই দেবে। যেমন নিম সাবান বললে সেই সাবানে নিমের নির্যাস থাকবে। স্যান্ডাল সাবানেও তাই। এ রকম প্রতিটি পণ্যে ব্র্যান্ড প্রমিজ পালন করব আমরা। যে ঘোষণা দেব, সে উপাদানই পণ্যে থাকবে।