Managing Director & CEO, Agribusiness
প্রথম আলো: আমাদের দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির যাত্রা শুরু হলো কবে?
এফ এইচ আনসারী: মূলত ১৯৮০ সালে। সেচযন্ত্রের মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতির যাত্রা শুরু। এর আগে ১৯৬৫ সালে প্রথম পাওয়ার টিলার আসে। কিন্তু কৃষকেরা তার সুফল খুব একটা পাননি। কারণ, কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। জমি চাষের জন্য গরুও। তা ছাড়া সবার ধারণা ছিল, কলের লাঙলের চেয়ে গরু দিয়ে চাষে ফলন বেশি হয়। উল্টো দিকে সেচযন্ত্র যখন এল, তখন মানুষ তার সুফল স্বচক্ষে দেখতে পেল। তখন পানির সংকট ছিল। ১৯৮১–৮২ সালে সরকার প্রণোদনা দেওয়ায় মাঠপর্যায়ে সেচযন্ত্র খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সেচকাজ করতে গিয়ে তখন কৃষকেরা সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতির তফাত বুঝতে পারলেন। পরে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহারেও কৃষকেরা দেখলেন, তুলনামূলক লাভ বেশি হচ্ছে। তবে আমরা দেখলাম, পাওয়ার টিলারে চাষ করতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। যেমন জমিতে গভীর চাষ দেওয়া যায় না। সেটির শ্রেষ্ঠ সমাধান হচ্ছে ট্রাক্টর। এতে পরিবেশদূষণও কম হয়। এক হেক্টর জমি চাষ করতে ট্রাক্টরে লাগে ১৬ লিটার জ্বালানি, আর পাওয়ার টিলারে ২২ লিটার। আমরা ট্রাক্টর নিয়ে এলাম। দেশি জমি চাষোপযোগী করতে বিদেশি কোম্পানিকে বলে ট্রাক্টরে কিছু পরিবর্তনও আনলাম। দেশে এখন ৯৫ শতাংশ জমি পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হচ্ছে। ৭৬ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় পাম্পের মাধ্যমে।
প্রথম আলো: প্রযুক্তির ব্যবহার ধান উৎপাদনে কী পরিবর্তন এনেছে?
আনসারী: সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করলে ধান উৎপাদনে ১৮-১৯ টাকা খরচ হয়। সব প্রক্রিয়া যন্ত্রের মাধ্যমে করা গেলে উৎপাদন ব্যয় ৯ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমানে বড় চিন্তা হচ্ছে, ধান বিক্রি করে প্রতি কেজির দাম ১৬-১৮ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কৃষকের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। এমন চললে যাঁরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন। ধান বাদ দিয়ে সবজি কিংবা অন্য ফসল করবেন। কিন্তু কৃষককে ধান চাষে রাখতে হবে। কারণ, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ধান উৎপাদন জরুরি। তাই কৃষকদের হাতে আরও উন্নত যন্ত্রপাতি তুলে দিতে হবে। এতে প্রতি কেজি ধান ৯ টাকায় উৎপাদন করে ১৬-১৭ টাকায় বিক্রি করা যাবে। কৃষকের মুনাফা থাকবে।
প্রথম আলো: কৃষিযন্ত্রে অনেক টাকা বিনিয়োগ লাগে। কৃষকেরা কি এত দাম দিয়ে যন্ত্র কিনতে পারছেন?
আনসারী: না, কৃষকেরা সেটি পারছেন না। তাঁরা যন্ত্র ভাড়া করে চাষ করছেন। আমরা এত দাম দিয়ে যন্ত্র কিনতে বলব না। একেকটা ট্রাক্টরের দাম ৯ লাখ টাকা। পাওয়ার টিলারের দাম দেড় লাখ টাকা। সেচপাম্পেরও যথেষ্ট দাম আছে। তা ছাড়া বিধিনিষেধও আছে। সবাই পাম্প বসাতে পারবেন না। তাই বলছি, সেবাদাতার কাছ থেকে যন্ত্র ভাড়া নেবেন। সেটি সাশ্রয়ী।
প্রথম আলো: অন্যান্য ফসল চাষে যন্ত্রের ব্যবহারের ভবিষ্যৎ কী?
আনসারী: আলু লাগানো ও তোলার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার দরকার। এটির জন্য আলাদা যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজন করেই করা যাবে। একইভাবে বাণিজ্যিকভাবে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষে যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব। চা–বাগানে অনেক ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। আনারসের বাগানে নিড়ানি ও আনারস তোলার জন্য যন্ত্র দিতে হবে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহারের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। কারণ, ২০০০ সালে দেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিলেন কৃষক। বর্তমানে সেটি কমে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০৫০ সালে তা ২০ শতাংশ হবে। ফলে বিপুলসংখ্যক জমি চাষের জন্য যন্ত্র ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: শিক্ষিত তরুণেরা কি কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তা হচ্ছেন?
আনসারী: তরুণদের অনেকে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর কিনছেন। তাঁদের পক্ষে এসব যন্ত্রপাতি চালানো ও ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাঁরা ব্যবসা ভালো বুঝতে পারেন।
প্রথম আলো: যন্ত্রপাতি কেনার সময় সবাই তো ভুর্তকি পান না। সে ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু কি করা যায়?
আনসারী: আমাদের কাছ থেকে কয়েকজন পুরো অর্থ দিয়ে যন্ত্র কিনে কৃষকদের সেবা দিয়েছেন। তাঁরা এক বছরের মধ্যে বিনিয়োগ তুলে এনেছেনও। তবে সবার কাছে তো অর্থ নেই। সে ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকির একটা অংশ সেবাদানকারী বা সার্ভিস প্রোভাইডার এবং একটি অংশ শিক্ষিত বেকারদের দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। সেটি হলে শিক্ষিত তরুণেরা কৃষিকাজে উৎসাহিত হবেন। নতুনদের জন্য আমার পরামর্শ, আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে এক বছর ব্যবসা করলেই সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে যাবেন।
প্রথম আলো: কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিতে কি শুল্ক আছে?
আনসারী: না। সরকার অনেক সুযোগ দিচ্ছে। এটি কাজে দিচ্ছে। আমি মনে করি, আরও আগে এটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল। দুই–তিন বছর আগে চিন্তাটি করা গেলে গত মৌসুমে ধান কাটা নিয়ে যে সমস্যা হলো, সেটি হতো না। সরকার বাজেটে সারের জন্য ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে রাখে। সারে ভর্তুকি দেওয়ায় চাষিদের প্রতি কেজি ধানে ১ থেকে দেড় টাকা সাশ্রয় হয়। কিন্তু ধান উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রপাতির সুবিধা দেওয়া গেলে উৎপাদন ব্যয় ৭০ শতাংশ কমে যাবে। আমি মনে করি, সারের ভর্তুকির অব্যবহৃত ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা যন্ত্রপাতি ও ভালো জাত উদ্ভাবনে ভর্তুকির জন্য দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো: কৃষিকাজ করে কৃষকেরা কি লাভ করতে পারছেন?
আনসারী: কৃষিতে লাভ আছে, তবে সবাই করতে পারেন না। বর্তমানে দেশে তিন ধরনের কৃষক আছেন, যাঁদের ৭ শতাংশের হাতে রয়েছে ২৫ শতাংশ জমি। তাঁরা নতুন প্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণ করেন। তাঁরা নানা ধরনের ফসল চাষ করেন। মূলত তাঁরাই মুনাফা করছেন। তার পরের ২০ শতাংশ কৃষকের হাতে আছে ৪২ শতাংশ জমি। তাঁরা দ্বিতীয় ধাপে প্রযুক্তি গ্রহণ করেন। তাঁরা মোটামুটি ভালো করছেন। বাকি ৬৩ শতাংশ কৃষককে কষ্ট করতে হয়।
প্রথম আলো: ৬৩ শতাংশ কৃষকের জন্য কী করা উচিত?
আনসারী: প্রাথমিকভাবে তাঁদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে। তবে সমিতিভিত্তিক বা সোশ্যাল অ্যাগ্রিকালচার ছাড়া সম্ভব নয়। সেটি হলে ১০০–২০০ কৃষক একজোট হয়ে তিন–চার রকমের ফসল উৎপাদন করতে পারেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় কাজটি শুরু হয়েছে।