Managing Director & CEO, ACI Motors Limited, ACI Agrolink Limited, Premiaflex Plastics Limited, ACI Agribusinesses
প্রথমেই একটা আনন্দের খবর দেওয়া যাক; সম্প্রতি প্রতিটি পত্রিকায়ই সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে যে, ফলমূলে এখন আর কোনো ফরমালিন নেই। সরকারের এ সমর্থনটা আমাদের দেশের কৃষকের জন্য বড় ব্যাপার। এই ফরমালিনের বিপক্ষে কিন্তু আমি দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছি। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে শাক সবজি চাষ করা হয়। এসবের ওপর নির্ভর করে অনেক পরিবারের জীবিকা। অথচ এই ফরমালিনের কারনে কিন্তু কৃষকদের একটা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। মানুষ সহজে কিছু কিনতে চাইত না, কারণ তারা মনে করতো এসবে ফরমালিন আছে। এখন সরকারের এ ধরনের প্রচার বা উদ্যোগের মাধ্যমে ফরমালিন সমস্যার সমাধান হবে।
মানুষ দেশি ফল পছন্দ করে। যখন প্রচার হতে লাগল যে, দেশি ফলে ফরমালিন আর কেবলই ফরমালিন; তখন বিদেশি ফলে বাজার ভরে গেল। দেশি শাক সবজি, ফল-মূল ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল। এখন তিন বছর পরে হলেও সরকার বলছে, দেশি ফল-মূল, শাক-সবজিতে ফরমালিন নেই। এখন এটার ব্যপক প্রচার দরকার। তাহলে মানুষের মধ্য থেকে আতঙ্ক কেটে যাবে।
আমাদের দেশে ফল-মূলে যে পরিমাণ ফরমালিন থাকে ওতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে সাধারণত কৃষকেরা ফরমালিন ব্যবহার করে না। কারণ, ফরমালিন ব্যবহার করলে মূল রঙটা হারিয়ে যায়। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলছি, কোনোভাবেই ফরমালিন নেই। আর যেটুকু ন্যাচারাল ফরমালিন থাকে সেটুকুতে মানুষের শরীরের কোনো ক্ষতি নেই।
আমাদের দেশীয় ফলে বিশেষ করে আমে দেখা যাচ্ছে আগের মতো সবুজ রঙটা পাচ্ছে না। আম পাকলে হলুদ অথবা লাল হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে আম এক্সপোর্ট করার জন্য ফ্রুট ব্যাগিং বা ঠোঙা লাগিয়ে বড় করা হচ্ছে। এটাকে হারভেস্ট করা হচ্ছে। এতে সূর্যের আলো কম পায় বলে সবুজ ভাবটা কম থাকে। আর পাকলে হলুদ হয়ে যায় অথবা লাল হয়ে যায়। আর সুবিধা হচ্ছে, এতে পোকা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর স্বাদটাও ভালো থাকে, দেখতেও ভালো হয়।
এখনো আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করে যে ফলে মাছি না বসলে ধরে নেওয়া হয় সেটায় ফরমালিন রয়েছে। কিন্তু বুঝতে হবে, বর্তমানে তো এমনিতেই মাছি নেই। মাছি না থাকলে বসবে কীভাবে? আর এ ধারণাটিও ভুল। ফরমালিন তো আর মাছি তাড়ায় না। ফমালিনের কাজ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া নির্গমন করা। এটি পঁচন রোধ করে।
লিচু অত্যন্ত রসালো ফল। এর মধ্যে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি পানি থাকে লিচুতে। এভাবে বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায় না। আর কোনোভাবে গুদামে রাখলেও সেখান থেকে বের করে বাজারজাত করার পর এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে পঁচন শুরু হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এটাকে জুস বানিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তাহলে মানুষ জুস পানের মাধ্যমে হলেও লিচুর স্বাদ পাবে।
কৃষিতে এসিআই বড় আকারে ভ্যালু অ্যাড করার চেষ্টা করছে। গমের মিল করেছে, ধানের মিল করেছে, লবনের মিল করেছে, ফুড প্রসেসিং করছে। এখন ফল সেক্টর নিয়েও কাজ করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। টমেটো বা যে কোনো ফল থেকে জুস বানানোর চিন্তা করা হচ্ছে। আম নিয়েও আমাদের চেষ্টা রয়েছে। আমের ভেতরেও পানির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে আমও বেশিদিন গুদামে রাখা কঠিন। ৩০ দিনের মতো স্টোরেজ করে রাখার একটা পথ কিংবা উপায় গবেষণা করে পাওয়া গেছে। তবে আমাদের দেশের পরিবেশ বা আমাদের দেশীয় জাত, এগুলোর ওপরে কিন্তু কোনও গবেষণা নেই। চীন বা ইন্দোনেশিয়ায় এ ধরনের গবেষণা রয়েছে। কারণ সেদেশে আম স্টোরেজ করে খাওয়া হয়। আমরাও চেষ্টা করছি, দেশীয় আম কীভাবে বেশি দিন ইকোনোমিক্যালি রাখা যায়। গবেষণা শেষ হলে এতে আমরা বিনিয়োগ করবো।
আমদের দেশে যেগুলো জুস বলে বিক্রি করা হয় এগুলো আসলে জুস নয়। এগুলো ড্রিংকস। এর কোনোটায় ফেভার যুক্ত করা হয় আবার কোনোটায় পাল্ব মেশানো হয়। পাল্বও ৬ শতাংশের বেশি থাকে না। তাই আমরা এগুলোকে জুস বলতে পারি না। তবে এ ড্রিংকসগুলোতে ক্যামিক্যাল থাকার কোনো সম্ভবনা নেই। কারণ, যে পানি ব্যবহার করা হয় সেগুলো ব্যাকটেরিয়া মুক্ত থাকে। যে পাল্ব ব্যবহার করা হয় সেগুলো এবং প্যাকেটগুলোও ব্যাকটেরিয়া মুক্ত থাকে। অতএব খাওয়া যাবে না এরকম ক্যামিক্যাল থাকে না। কিন্তু যে ফেভার ও রঙ ব্যবহার করা হয় সেটি ক্যামিক্যাল হলেও খাওয়া যায়।
যে কোনো কিছু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে হলে আগে সেটির জাত বাছাই করতে হবে। টমেটো যেমন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখলেও স্বাভাবিকভাবেই ১৪/১৫ দিন থাকবে। কেবল রোদে না রাখলেই হবে। এক্ষেত্রে বাড়তি কিছু করার প্রয়োজন নেই। আর একটু ঠান্ডা জায়গায় রাখতে পারলে আরো দু’দিন বেশি থাকবে। এটি হারভেস্ট করার পর একটা বক্সে রাখলে এবং বক্সের মুখ যদি খোলা থাকে তাহলে আরও দু’একদিন বেশি সংরক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু যখনই টমেটোকে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে তখনই এটি দ্রুত নষ্ট হতে থাকবে। আসলে একটু সুন্দরভাবে স্টোরেজ করলেই কিছুদিন বেশি সংরক্ষণ করা সম্ভব। এরজন্য বেশি কিছু করতে হবে না।
আমাদের দেশে অর্গানিক ফুড খাওয়া একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এটি জরুরি নয়। অর্গানিক ও নন অর্গানিকের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে, বাংলাদেশের খাবারে তেমন কোনো হেভি ম্যাটার বা ক্ষতিকর ক্যামিক্যাল নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে। আর ব্যাকটেরিয়া অর্গানিক ফুডেও থাকতে পারে। ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত পানি থেকে যুক্ত হয়। এটি অর্গানিক ফুড ধুলেও যোগ হবে নন অর্গানিক ফুড ধুলেও যোগ হবে। তাই আমি জোর দিয়েই বলছি, অর্গানিক ফুড আমাদের দেশে মোটেও জরুরি নয়। এটা সম্পূর্ণ সাইকোলজিক্যাল বিষয়। আর যারা এসব উৎপাদন করছেন তারাও কিন্তু বাণিজ্যিক কারণেই উৎপাদন করছেন।<
আমাদের বাজেটের আকার বড় হচ্ছে কিন্তু এটার তো প্রয়োজনও রয়েছে। রাস্তাঘাট বানাতে হয়, হাসপাতাল বানাতে হয়, ওষুধ কিনতে হয়। সেক্ষেত্রে আমি বলবো যে, কৃষি খাতে যে বাজেট দেয়া হয়েছে, এটা ছোট না বড় তা কোনো বিষয় না। বিষয় হচ্ছে যতটুকুই পাই সেটুকুকে এমনভাবে ব্যবহার করা যেন সত্যিকার অর্থে একটা ফলাফল আসে।
আর অ্যানিমেল ফার্মিংয়ে সরকার যে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স মওকুফ করেছে সেটির সময় আরো বাড়াতে হবে। এটাকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত করতে হবে। কারণ, আমরা পোল্ট্রিতে এখনো স্বংয়সম্পূর্ণ নই। পোল্ট্রি এমন একটি সেক্টর যেখানে অতি অল্প সময়ে মাংস উৎপাদন করা যায়। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে মেধাবি রাখতে হলে প্রোটিন বা আমিষ খাওয়াতে হবে। আর প্রোটিনের বড় অংশের যোগান দিচ্ছে পোল্ট্রি। তাই এই শিল্পকে সহায়তা দেওয়া জরুরি।
কৃষির আরেকটি এরিয়া বা উপখাত হচ্ছে প্রাণীসম্পদ আরো সহজ করে বললে, গরু। জাতি হিসেবে আমরা অনেক কম গরুর দুধ খাই। বৈশ্বিক তো বটেই সার্কের দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম। আমাদের গরুর দুধ খাওয়া বাড়াতে হবে। গরুর দুধে অনেক বেশি প্রোটিন আছে। মানুষের মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য গরুর দুধ খুবই কার্যকর। এই দুধ উৎপাদনে কৃষককে উৎসাহী করতে হবে। এজন্য ভালো জাতের গাভী তৈরি করতে হবে। আর ভালো জাতের গাভী তৈরি করতে হলে বেসরকারি খাতকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এতে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রাইভেট সেক্টর তো সরকারের কাছে টাকা চাচ্ছে না। প্রাইভেট সেক্টর একটু নির্বিঘেœ উন্নত জাতের গরু উৎপাদনের নিশ্চয়তা পেলেই হবে। আবারো বলছি এখানে সরকারেরই উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার উদ্যোগ নিলে কৃষির সব উপখাত থেকেই প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। বেকার শিক্ষিত যুবকরাও এতে স্বাবলম্বী হবে। জিন্স পড়ে যুবকরা কৃষি কাজে নামবে না ঠিক আছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারলে তারা জিন্সের প্যান্ট পড়েই মেশিনে বসে কাজ করবে। এতে বেকারত্বও দূর হবে। দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। এজন্য তরুণদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের উৎসাহী করতে হবে।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে কৃষি বিষয়ক স্নাতক কিংবা ডিপ্লোমা আছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এগুলো তো উচ্চ পর্যায় কিংবা উচ্চবিত্তের মানুষদের জন্য। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে তারা বড় বড় জায়গায় চাকরি করেন। অথবা গবেষণা করেন। তাই সাধারণ কৃষি পর্যায়ে উন্নতির জন্য কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র জরুরি। কিংবা আমি বলবো, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করবে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। অনেকে রয়েছেন কিছু দিন বিদেশে থেকে এসে দেশে ভালো কিছু করতে ইচ্ছুক। কিন্তু কী করবে বুঝে উঠতে পারছেন না। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের কাছ থেকে কৃষির জন্য ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব। তাহলে প্রশিক্ষিতরা কাজটিকে দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারবে। সেটি শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়। প্রাণীসম্পদ খাতেও জরুরি।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে, দেশীয় একটি মুরগির যেখানে ১ কেজি ওজন হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে সেখানে একটি ফার্মের মুরগি মাত্র এক মাসে এক কেজি, দেড় কেজি ওজন হয় তাহলে এটি হয়তো ক্ষতিকর। কিন্তু আসলে এটি মোটেও ক্ষতিকর নয়। দ্রুত ওজন বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে জাত। জাত একটা বড় ফ্যাক্টর বা বিষয। পোল্ট্রি মুরগিকে একটি শঙ্কর জাত হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এ জাতের মুরগিগুলো এভাবেই গ্রো করবে। এটাকে কোনো হরমোন বা ক্ষতিকর অন্যকোনো কিছু দেওয়া হয় না। ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। কারণ, ভ্যাক্সিন না দিলে ডিজিজ বা অসুখ চলে আসবে। মানুষকে যেভাবে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় ওদেরও সেভাবে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। এটি মোটেও ক্ষতিকর না। এটা নির্বিঘ্নে খাওয়া যাবে।