বাইকারদের ‘নিরাপত্তা’ এবিএসে
মোটরসাইকেল এখন জনপ্রিয় বাহন। কিন্তু দুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবিএস প্রযুক্তি সেই ঝুঁকিই কমিয়ে দিয়েছে।
আবার না কিনেও উপায় নেই। শহরে গণপরিবহনের অভাব। গ্রামে ভটভটি, নছিমনে ওঠা দায়। যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে, তাঁদের কথা আলাদা। যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁদের নিজস্ব বাহনের জন্য ভরসা মোটরসাইকেল। তাহলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী?
জেনে রাখা ভালো, বাজারে এখন অনেক শক্তিশালী মোটরসাইকেল আসছে। আসছে নতুন প্রযুক্তি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য। তেমনই এক প্রযুক্তি অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস)। এ প্রযুক্তি মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়েছে বলে দাবি করছে বাজারজাতকারী কোম্পানি ও মোটরসাইকেলের চালকেরা।
দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ মোটরসাইকেল চালানোর সময় হঠাৎ সামনে কিছু একটা এসে পড়া, যখন কষে ব্রেক চাপতে হয়। হতে পারে রাস্তার কোনো গর্ত, চিহ্নহীন গতিরোধক বা স্পিড ব্রেকার, কোনো যানবাহন, প্রাণী অথবা অসতর্ক পথচারী। হঠাৎ কড়াভাবে ব্রেক চাপলে চাকা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেলে ব্রেক চাপলেও চাকা একবারে আটকে যায় না। এতে পিছলে যাওয়া বা স্কিড করার ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে।
ধরেন, আপনি রাস্তা ফাঁকা পেয়ে মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়েছেন। হঠাৎ একটি কুকুর এসে আপনার সামনে পড়ল। আপনার মোটরসাইকেল যদি এবিএস প্রযুক্তির হয়, তাহলে আপনি কষে ব্রেক করলেও চাকা পিছলে পড়ে যাবেন না।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল নিয়ে আসে জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের একমাত্র পরিবেশক এসিআই মোটরস, ২০১৯ সালের এপ্রিলে। বাজারে এখন তাদের তিনটি মডেলের এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল পাওয়া যাচ্ছে। জনপ্রিয়তা কতটুকু সেটা জানতে শুরুর একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়, এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেলের একটি মডেলের অগ্রিম ফরমাশ বা প্রি বুকিং হয়েছিল দুই হাজারের বেশি। এ ছাড়া দেশে আনার পর দ্রুতই ফুরিয়ে গিয়েছিল মজুত বা স্টক।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে ইয়ামাহার একমাত্র পরিবেশক হয় এসিআই মোটরস।
এবিএসের ইতিহাস
বাংলাদেশে নতুন হলেও মোটরসাইকেলে এবিএস প্রযুক্তি অনেক আগে থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। শুরুতে এবিএস প্রযুক্তি আসে উড়োজাহাজ ও গাড়িতে। যুক্তরাষ্ট্রের পপুলার সায়েন্স নামের একটি ম্যাগাজিনের ১৯৮৭ সালের একটি সংখ্যায় বলা হয়, মোটরসাইকেলে এবিএস প্রযুক্তি প্রথম আনে জার্মানির অটোমোবাইল কোম্পানি বিএমডব্লিউ। তারা আরেক জার্মান কোম্পানি এফএজি কুগেলফিশারের সঙ্গে যৌথভাবে মোটরসাইকেলে এবিএস প্রযুক্তি সংযুক্ত করে।
১৯৮৮ সালে বিএমডব্লিউ প্রথম এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল বাজারে ছাড়ে। জাপানি কোম্পানিগুলো এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল বাজারে আনে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
কীভাবে কাজ করে
আগেই বলেছি, এবিএসের পূর্ণ রূপ হলো অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম। সাধারণ প্রযুক্তির মোটরসাইকেলে গতি একটু বেশি থাকা অবস্থায় কষে ব্রেক করলে চাকা একসঙ্গে আটকে যায়। কিন্তু মোটরসাইকেলটির ভরবেগ থেকে যায়। ফলে চাকা পিছলে চালক মোটরসাইকেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান। এতে মোটরসাইকেলটি ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে গিয়ে খাদে পড়া অথবা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা প্রবল। ফল মারাত্মক দুর্ঘটনা।
এবিএসে চাকা একসঙ্গে আটকায় না। তেজগাঁওয়ে ইয়ামাহার বিক্রয় ও মেরামত কেন্দ্রের (থ্রি এস সেন্টার) সিনিয়র সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার বিভাস কুমার দাস বলেন, এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেলে যখন ব্রেক চাপা হয়, তখন ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিটে একটি সংকেত যায়। কন্ট্রোল ইউনিট তখন ব্রেক ফ্লুইড থেমে থেমে ছাড়ে। এতে ব্রেকের প্যাড ডিস্ককে একবারে আটকে রাখে না, থেমে থেমে আটকায়। যার ফলে ব্রেক চেপে ধরলেও মোটরসাইকেলের চাকা একবারে পুরোপুরি আটকে যায় না।
ব্যবহার কীভাবে
এবিএস ব্যবহারে আপনাকে বাড়তি কিছু করতে হবে না। শুধু এ প্রযুক্তির মোটরসাইকেল কিনতে হবে। তারপর মোটরসাইকেল মোটামুটি গতিতে চালানোর সময় থামাতে ব্রেক একবারে চেপে ধরতে হবে। চেপে ধরলেই এবিএস সক্রিয় হবে।
এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেলে যখন চাবি ঢোকানো হয়, তখন একটি সংকেত বাতি জ্বলে ওঠে। এতেই বোঝা যায় এবিএস রয়েছে। অবশ্য চালানোর সময় এ বাতি আর জ্বলবে না।
চালানোর সময় ব্রেক কষার পর এবিএস সক্রিয় হলে ব্রেক প্যাড বা পাদানিতে একটু কম্পন হয়। তা থেকেও চালক বুঝতে পারেন, এবিএস সক্রিয়।
এসিআই মোটরসের ম্যানেজার (সার্ভিস অ্যান্ড স্পেয়ারস) মো. রোকন সরকার বলেন, ভারতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল ব্যবহারে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে ৩৭ শতাংশ। আর ব্রেকের দক্ষতা বাড়ে ২৯ শতাংশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এবিএস খুবই জরুরি। অনেক দেশে তো কিছু কিছু মডেলে এবিএস বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার।
রোকন সরকার আরও বলেন, ইয়ামাহার বেশির ভাগ মডেলে মনোক্রস সাসপেনশন ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে এবিএস। দুই মিলে মোটরসাইকেল চালানো স্বস্তিদায়ক করে। আবার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয়।
কোন কোন মডেল
দেশের বাজারে ইয়ামাহার তিনটি মডেলের মোটরসাইকেলে এবিএস প্রযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতা) ইয়ামাহা এফজেডএস এফআই ভার্সন থ্রির দাম ২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। ১৫০ সিসির ইয়ামাহা এফজেড এফআই ভার্সন থ্রির দাম ২ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ১৫৫ সিসির ইয়ামাহা আরওয়ানফাইভ ভার্সন থ্রির দাম ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এখন অবশ্য প্রতিটি বাইকে ১০ হাজার টাকা ছাড় মিলছে, যা চলবে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর বাইরে আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছে।
সারা দেশে এসিআইয়ের ৬০টির বেশি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ইয়ামাহার মোটরসাইকেল বাজারজাত করে। প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে গ্রাহকেরা মোটরসাইকেল মেরামত করতে পারবেন। এ ছাড়া পাওয়া যায় খুচরা যন্ত্রাংশ। সেবা পেয়ে কতটা সন্তুষ্ট, তা আবার অ্যাপের মাধ্যমে জানানো যায়। এসিআই জানিয়েছে, তাদের গ্রাহক সন্তুষ্টির মাত্রা ৮৫ শতাংশ।
ইয়ামাহা জাপান ও ভারত থেকে প্রশিক্ষক এনে এ দেশের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। এরপর প্রশিক্ষিতরা মোটরসাইকেল যাঁরা মেরামত করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন। এ ছাড়া মোটরসাইকেলের সমস্যা শনাক্ত করতে এসিআই ব্যবহার করে ডায়াগনোসিস টুলস। এতে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় মোটরসাইকেলের সেন্সরভিত্তিক সমস্যাগুলো ধরা পড়ে।
এসিআই মোটরসের ম্যানেজার (সার্ভিস অ্যান্ড স্পেয়ারস) মো. রোকন সরকার বলেন, ‘আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ সেবা খুবই উন্নত মানের।’
তাহলে এবিএস না সাধারণ?
দেশে মোটরসাইকেল বাড়বেই। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব বাহনের চাহিদা বাড়ে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানে যেভাবে চাহিদা বেড়েছে, বাংলাদেশও সেদিকে এগোচ্ছে।
যাঁরা একটু বাড়তি খরচ করতে পারেন, তাঁরা কোন মোটরসাইকেলটি কিনবেন? জানতে চাইলে আরিফুল হক নামের একজন অভিজ্ঞ মোটরসাইকেলচালক বলেন, বাংলাদেশে সড়কে কেউ শৃঙ্খলা মানে না। তাই একটু বেশি খরচ করতে পারলে এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল কেনা উচিত।
ইয়ামাহা এফজেডএস এফআই ভার্সন থ্রি মডেলের মোটরসাইকেল আট মাস ধরে চালাচ্ছেন আরিফুল হক। মোটরসাইকেল নিয়েই কক্সবাজার, বান্দরবান, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলা ঘুরেছেন। তিনি এক দিনের অভিজ্ঞতা জানান। বলেন, ‘কক্সবাজারে যাওয়ার পথে কুমিল্লায় রাতে একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে হঠাৎ দেখি সামনে একটি ট্রাক, যার পেছনে কোনো লাইট জ্বলছে না। ব্রেক চেপে ধরলাম। মোটরসাইকেলের গতি কমল।’ তিনি বলেন, ওই দিন এবিএস ছাড়া সাধারণ প্রযুক্তির মোটরসাইকেল হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটত।
৯ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালান নাজমুস সাকিব। পাশাপাশি মোটরসাইকেলের একটি ভক্তগোষ্ঠী বা ফ্যানক্লাবের সক্রিয় সদস্য তিনি। কেউ মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে পরামর্শ চাইলে কী বলবেন, জানতে চাইলে নাজমুস সাকিব বলেন, ‘আমি বলব, অবশ্যই এবিএস প্রযুক্তির মোটরসাইকেল কেনা উচিত।’